আনন্দ বিনোদনরচনা-প্রবন্ধ

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

মুফতী তাহমীদ শামী

প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, স্নেহ-প্রীতি, ভক্তি-শ্রদ্ধা ইত্যাদি রবের পক্ষ হতে বান্দার প্রতি সিমাহীন অনুগ্রহ৷ যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَمِنْ اٰيٰتِهٖۤ اَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوْۤا اِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَّوَدَّةً وَّرَحْمَةً ؕ اِنَّ فِىْ ذٰ لِكَ لَاٰيٰتٍ لِّقَوْمٍ يَّتَفَكَّرُوْنَ.
আর তাঁহার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রহিয়াছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি করিয়াছেন তোমাদের সংগিনীদেরকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করিয়াছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রহিয়াছে। (সূরা রূম ২১ আয়াত৷)
তাই ভালোবাসা হলো আত্মার তৃপ্তি৷ মনের প্রশান্তি। জীবন চলার পাথেয়৷ আল্লাহ তায়ালা আমাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা শিক্ষা দিয়েছেন, যা কোনো বিশেষ দিবসের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও উত্তম চরিত্রমাধুর্য দ্বারা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জয় করে নিয়েছেন শত কোটি মানুষের হৃদয়, বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন ইসলামের বিকিরণ। প্রতিটি ভালোবাসা হতে হবে আবেগ, বিবেক ও স্রষ্টার সম্মতির সমন্বয়। কিন্তু যে ভালোবাসা হয় শুধু আবেগ বা কুপ্রবৃত্তির, সে ভালোবাসা মানুষের ইহকাল-পরকাল উভয়কে ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় মানুষের মনুষ্যত্বকে, জাগরিত করে পশুত্বের হিংস্র বৈশিষ্ট্যকে৷
দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান বিশ্বে ভালোবাসা দিবসের নামে উৎপত্তি হচ্ছে নানান অপসংস্কৃতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড৷ ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন৷ যা ইসলামের নীতি ও আদর্শবহির্ভূত।আর তাইতো নৈতিক অবক্ষয় দাবানলের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে।
#ভালোবাসা_দিবসের_সূচনাঃ
নোংরা ও জঘন্য ইতিহাসের স্মৃতিচারণের নাম বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এ ইতিহাসটির বয়স ১৭৩৭ বছর হলেও বিশ্ব ভালবাসা দিবস নামে এর চর্চা শুরু হয় সাম্প্রতিক কালেই।
২৭০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারীর কথা। তখন রোমের সম্রাট ছিলেন ক্লডিয়াস। সে সময় ভ্যালেন্টাইন নামে একজন সাধু ছিল, যিনি তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকাদেরকে গোপন পরিণয়-মন্ত্রে দীক্ষা দিত। এ অপরাধে সম্রাট ক্লডিয়াস সাধু ভ্যালেন্টাইনের শিরশ্ছেদ করেন। আর যেদিন তাকে শিরশ্ছেদ করা হয়, সেদিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারী৷ তার এ ভ্যালেন্টাইন নাম থেকেই এ দিনটির নাম করণ করা হয় ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ যা আজকের ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’।
বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয় ১৯৯৩ ইং সাল থেকে। কিছু ব্যবসায়ীর মদদে এটি প্রথম চালু হয়৷ অপরিণামদর্শী মিডিয়া কর্মীরা এর ব্যাপক কভারেজ দেয়। আর যায় কোথায়! লুফে নেয় তাকে বাংলার তরুণ-তরুণীরা। এরপর থেকে মুসলমানের মধ্যে বৈধ ভালবাসার পরিবর্তে অবৈধ ভালোবাসা বেঁধে দেয়ার কাজটা যথারীতি চলছে। আর এর ঠিক পিছনেই মানব জাতির আজন্ম শত্রু মিষ্টার ইবলিস এইডস নামক মরণ-পেয়ালা হাতে নিয়ে খিলখিল করে হাসছে। মানুষ যখন বিশ্ব ভালবাসা দিবস সম্পর্কে জানত না, তখন পৃথিবীতে ভালবাসার অভাব ছিলনা। আজ পৃথিবীতে ভালবাসার বড়ই অভাব। তাই দিবস পালন করে ভালবাসার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়! আর হবেই না কেন! অপবিত্রতা নোংরামি ও শঠতার মাঝে তো আর প্রকৃত ভালোবাসা নামক বস্তুটি থাকতে পারে না। তাই আল্লাহ তায়ালা মানুষের হৃদয় মন থেকে ভালবাসা উঠিয়ে নিয়েছেন।
#বিশ্ব_ভালোবাসা_দিবসকে_চেনার_কিছু_বাস্তব_নমুনাঃ
দিনটি যখন আসে তখন শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা তো একেবারে বেসামাল হয়ে উঠে। নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য উজাড় করে প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় নেমে পড়ে। শুধুই কি তাই ! অঙ্কন পটীয়সীরা উল্কি আঁকার জন্য পসরা সাজিয়ে বসে থাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে৷ তাদের সামনে তরুণীরা পেট-পিঠ,বুক-বাহু আর হস্তদ্বয় মেলে ধরে পছন্দের উল্কিটি এঁকে দেয়ার জন্য। তারপর রাত পর্যন্ত নীরবে-নিবৃতে চলে প্রেমিক- প্রেমিকার অবৈধ আনন্দ উল্যাস৷ যেদিন অকালেই হাড়িয়ে ফেলে কত নারী তার সর্বদামী সতিত্ব৷ এ হলো বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের কর্মসূচি!
আমি বলি কি
এ দিবসটিকে বিশ্ব ভালবাসা দিবস না বলে বিশ্ব বেহায়াপনা দিবস বললে অন্তত নামকরণটি যথার্থ হতো।
#বিশ্ব_ভালোবাসা_দিবস_পালনের_ক্ষতিকর_কিছু_দিকঃ
☞ ভালোবাসা নামের এ শব্দটির সাথে এক চরিত্রহীন লম্পটের স্মৃতি জড়িয়ে যারা ভালোবাসার জয়গান গেয়ে চলেছে, পৃথিবীবাসীকে তারা সোনার পেয়ালায় করে নীল বিষ পান করিয়ে বেড়াচ্ছে।
☞ তরুণ তরুণদের সস্তা যৌন আবেগকে সুড়সুড়ি দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও ফাসাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ তারা তো পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়। আর আল্লাহ ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের ভালবাসেন না। (সূরা মায়িদা ৬৪ আয়াত৷)
☞ নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনা জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি লাভ করছে। যারা ঈমানদারদের সমাজে এ ধরণের অশ্লীলতার বিস্তার ঘটায়, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি.. (সূরাহ নূর ১৯ আয়াত৷)
বস্তুত যে সমাজেই চরিত্র-হীনতার কাজ ব্যাপক, তথায় আল্লাহর নিকট থেকে কঠিন আযাবসমূহ ক্রমাগত অবতীর্ণ হওয়া অবধারিত, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্লজ্জতা প্রকাশমান এবং তারা এর ব্যাপক প্রচারেরও ব্যবস্থা করে, তার অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ মহামারি, সংক্রামক রোগ এবং ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ এত প্রকট হয়ে দেখা দিবে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনই দেখা যায় নি। (সুনানে ইবনে মাজাহ ৪০০৯ হাদীস৷)
☞ তরুণ তরুণীরা বিবাহ পূর্ব দৈহিক সম্পর্ক গড়তে কোন রকম কুণ্ঠাবোধ করছে না। অথচ তরুণ ইউসুফ আলাইহিস সালামকে যখন মিশরের মহা এক রানী অভিসারে ডেকেছিল, তখন তিনি কারা বরণকেই এহেন অপকর্মের চেয়ে উত্তম জ্ঞান করেছিলেন। যুব-চরিত্রকে পবিত্র রাখার জন্য তিনি অতুলনীয় ও উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন! আল্লাহ তায়ালা সূরা ইউসুফের ২৩-৩৪ নং আয়াত পর্যন্ত এ ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন৷
☞ শরীরে উল্কি আঁকাতে যেয়ে নিজের ইয্‌যত-আব্রু পরপুরুষকে দেখানো হয়। যা প্রকাশ্য কবিরা গুনাহ। যেমন হাদীস শরীফে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি উল্কি আঁকে এবং যে আঁকায়, উভয়য়ের উপরই আল্লাহর লা‘নত। (সহীহুল বুখারী ৫৪৭৭ হাদীস৷)
মূলত যার লজ্জা নেই, তার পক্ষে এহেন কাজ নেই যা করা সম্ভব নয়। তাইতো হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি তোমার লজ্জা না থাকে, তাহলে যা ইচ্ছা তুমি তাই করতে পার। (সহীহুল বুখারী ৩২২৫ হাদীস৷)
☞ ভালোবাসা দিবসের নামে নির্লজ্জতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে যিনা-ব্যভিচার, খুন-খারাবী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিঃ থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে জনগোষ্ঠীর-মধ্যে ব্যভিচার ব্যাপক হবে, তথায় মৃত্যুর আধিক্য ব্যাপক হয়ে দেখা দেবে। (মুয়াত্তা মালিক ৮৭০ হাদীস৷)
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের ভাষ্য কতটা বাস্তব, বর্তমান বিশ্বের চিত্র এর প্রমাণ বহন করছে।
সুতরাং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী কোন মুসলমানের জন্য এ দিবস পালন করা বা এটাকে সমর্থন করা অথবা এ উপলক্ষে প্রেম-ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা বিনিময় করা জায়েয হবে না। অতএব তা পরিহার করা উচিত!
#সৌজন্যেঃ
আত-তাহমীদ ইসলামীক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ৷
তারিখ-১২/২/২০ ইসায়ী৷

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button