রমযানুল মোবারক খাইর বরকত ও রহমতের বসন্তকাল৷ বরং এর বাস্তব অবস্থা শব্দ ও বাক্যের গাঁথুনিতে প্রকাশ করা অসম্ভব৷ এ মাসের দিনে আল্লাহ তায়ালা রোযা ফরয করেছেন এবং রাতে কিয়ামুল লাইল তথা তারাবীহ আদায় করাকে হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নাত করে দিয়েছেন৷ অতএব, রমযানের খাইর ও বরকত পুর্নরুপে হাসিল করতে হলে অবশ্যই তারাবীহ নামাযে যত্নবান হতে হবে৷
#তারাবীহ_নামাযের_ফযিলতঃ
হাদীস শরীফে বর্নিত হয়েছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه ـ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لِرَمَضَانَ “ مَنْ قَامَهُ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ”.
হযরত আবূ হুরায়রা রাযিঃ থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় তারাবীর নামায আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। সনদ সহীহ৷ (সহীহুল বুখারী ২০০৮, ২০০৯ হাদীস৷ সুনানে আবু দাউদ ১৩৭১ হাদীস৷ সহীহ আত-তারগীব ৯৮২ হাদীস৷)
#তারাবীহ_নামাযের_রাকাত_সংখ্যাঃ
তারাবীহ নামায ২০ রাকাত৷
হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম রাযিঃ, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, মুজতাহিদ ইমামগণ এবং সমগ্র উম্মতে মুসলিমার ঐক্যমত্বের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তারাবীহ নামায ২০ রাকাত। (ফতোয়ায়ে শামী ১/৫১১ পৃষ্ঠা৷ ফতোয়ায়ে আলমগীরী ১/১৫০ পৃষ্ঠা৷ ফতোয়ায়ে উসমানী ২/২৩৩ পৃষ্ঠা৷ ফতোয়ায়ে জামেয়া ১/১৪৬ পৃষ্ঠা৷ আহসানুল ফতোয়া ৩/৫২৪ পৃষ্ঠা৷ আশরাফুল হিদায়া ১/৫০১-৫০২ পৃষ্ঠা৷ বাদায়েউস সানায়ে ১/২৮৮ পৃষ্ঠা৷)
#নবীজীর_তারাবীহঃ
হাদীস শরীফে বর্নিত আছেঃ
عن ابن عباس ان رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلى فى رمضان عشرين ركعة والوتر.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিঃ থেকে বর্ণিত। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবীহ এবং ৩-রাকাত বিতির পড়তেন। সনদ সহীহ৷ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৭৬৯২ হাদীস৷ সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪৩৯১ হাদীস৷ আল মুজামুল কাবীর ১২১০২ হাদীস৷ মাজমাউজ যাওয়ায়েদ ১৭২ হাদীস৷)
হাদীস শরীফে আরও বর্নিত হয়েছে-
عن جابر بن عبد الله قال خرج النبى صلى الله عليه وسلم ذات ليلة فى رمضان فصلى الناس اربعة وعشرون ركعة واوتر بثلاثة
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাযিঃ বলেছেনঃ একদা রমজান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাসজিদে নববীতে তাশরীফ নিয়ে আসলেন এবং লোকদের নিয়ে চব্বিশ রাকাত নামায আদায় করলেন৷ তথা ৪-রাকাত ফরয,২০ রাকাত তারাবীহ এবং ৩ রাকাত বিতির। সনদ সহীহ৷ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৭৬৯২ হাদীস৷ তারীখে জুরজান ৫৫৭ হাদীস৷ মুসনাদে হুমাইদ ২১৮ পৃষ্ঠা৷)
অপর হাদীসে বর্নিত হয়েছে-
عَنْ عَائِشَةَـ رضى الله عنها ـ أَخْبَرَتْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم خَرَجَ لَيْلَةً مِنْ جَوْفِ اللَّيْلِ، فَصَلَّى فِي الْمَسْجِدِ، وَصَلَّى رِجَالٌ بِصَلاَتِهِ، فَأَصْبَحَ النَّاسُ فَتَحَدَّثُوا، فَاجْتَمَعَ أَكْثَرُ مِنْهُمْ، فَصَلَّوْا مَعَهُ، فَأَصْبَحَ النَّاسُ فَتَحَدَّثُوا، فَكَثُرَ أَهْلُ الْمَسْجِدِ مِنَ اللَّيْلَةِ الثَّالِثَةِ، فَخَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَصَلَّى، فَصَلَّوْا بِصَلاَتِهِ، فَلَمَّا كَانَتِ اللَّيْلَةُ الرَّابِعَةُ عَجَزَ الْمَسْجِدُ عَنْ أَهْلِهِ، حَتَّى خَرَجَ لِصَلاَةِ الصُّبْحِ، فَلَمَّا قَضَى الْفَجْرَ أَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ، فَتَشَهَّدَ ثُمَّ قَالَ “ أَمَّا بَعْدُ، فَإِنَّهُ لَمْ يَخْفَ عَلَىَّ مَكَانُكُمْ، وَلَكِنِّي خَشِيتُ أَنْ تُفْتَرَضَ عَلَيْكُمْ فَتَعْجِزُوا عَنْهَا ”. فَتُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَالأَمْرُ عَلَى ذَلِكَ•
আম্মাজান হযরত আয়িশাহ সিদ্দীকা রাযিঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাসজিদে নববীতে তাশরীফ আনেন এবং লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করেন৷ সকালে লোকেরা এ সম্পর্কে আলোচনা করলে পরদিন অধিক সংখ্যক লোক সমবেত হয় এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করেন৷ সকালে আবার তাঁরা এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন, যার ফলে তৃতীয় রাতে মাসজিদে মুসল্লীর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়, এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ আনেন ও তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করেন৷ অতপর চতুর্থ রাতে মাসজিদে মুসল্লীর সংকুলান হল না, কিন্তু সে রাতে তিনি আর তাশরিফ আনেন নি৷ বরং ফজরের নামাযে বেরিয়ে আসলেন এবং নামায শেষে লোকদের দিকে ফিরে প্রথমে তাওহীদ ও রিসালতের সাক্ষ্য দেয়ার পর বললেনঃ শোন! তোমাদের গতরাতের অবস্থা আমার অজানা ছিল না৷ কিন্তু আমি আশংকাভোধ করছি তারাবীর নামায তোমাদের উপর ফরয করে দেওয়া হয় কিনা? কেননা এমনটি হলে তা আদায়ে অপারগ হয়ে পড়তে। অতপর বিষয়টি এভাবেই থেকে যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ওফাত পর্যন্ত৷ সনদ সহীহ৷ (সহীহুল বুখারী ২০১২ হাদীস৷ সহীহু মুসলিম৷ সুনানে আবু দাউদ ১৩৭৩ হাদীস৷ মুয়াত্তা মালিক ২৪০ হাদীস৷ আশরাফুল হিদায়া ১/৫০২ পৃষ্ঠা৷)
উক্ত হাদীসগুলো দ্বারা দুটি বিষয় প্রমানিত হয়ঃ
১৷ হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২০রাকাত তারাবীহ পড়েছেন৷
২৷ হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবীর জামাআত কায়েম করেছেন৷ শুধু উম্মতের মায়ায় ফরয হবার আশংকায় তিন দিনের অধিক জামাআত কায়েম করেননি৷
(আত-তাহমীদ)
#খোলাফায়ে_রাশেদীনের_তারাবীহঃ
সহীহ সনদে প্রমাণিত যে, খুলাফায়ে রাশেদীন বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিঃ বলেন- বিশ রাকাত তারাবীহ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতের দ্বারা প্রমাণিত। (ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া ২৩/১১৩ পৃষ্ঠা৷ ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া ২/৩৪৯ পৃষ্ঠা৷ ফতোয়ায়ে ইউনুসিয়া ২/৩৯০ পৃষ্ঠা৷ সিলসিলায়ে তারাবীহ ২৮-৫৬ পৃষ্ঠা৷)
#হযরত_আবু_বকর_সিদ্দীক_রাযিঃ_এর_তারাবীহঃ
হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযিঃ ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন৷ যেমন ইবনু শিহাব রহিঃ বলেছেনঃ হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পুর্ব থেকে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযিঃ- এর খিলাফতকাল ও হযরত উমর রাযিঃ- এর খিলাফতের প্রথমভাগে হযরত সাহাবায়ে কিরাম রাযিঃ একাকিভাবে কিংবা কয়েকজন মিলে জামাআতে ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন৷ (সহীহুল বুখারী ২০০৯ হাদীস৷ সহীহু মুসলিম৷ মুয়াত্তা মালিক ২৪১ হাদীস৷ ফতোয়ায়ে ইউনুসিয়া ২/৩৯১ পৃষ্ঠা৷ সিলসিলায়ে তারাবীহ ২৮-৫৬ পৃষ্ঠা৷)
#হযরত_উমর_রাযিঃ_এর_তারাবীহঃ
হাদীস শরীফে বর্নিত হয়েছে-
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَبْدٍ الْقَارِيِّ، أَنَّهُ قَالَ خَرَجْتُ مَعَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ـ رضى الله عنه ـ لَيْلَةً فِي رَمَضَانَ، إِلَى الْمَسْجِدِ، فَإِذَا النَّاسُ أَوْزَاعٌ مُتَفَرِّقُونَ يُصَلِّي الرَّجُلُ لِنَفْسِهِ، وَيُصَلِّي الرَّجُلُ فَيُصَلِّي بِصَلاَتِهِ الرَّهْطُ فَقَالَ عُمَرُ إِنِّي أَرَى لَوْ جَمَعْتُ هَؤُلاَءِ عَلَى قَارِئٍ وَاحِدٍ لَكَانَ أَمْثَلَ. ثُمَّ عَزَمَ فَجَمَعَهُمْ عَلَى أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ، ثُمَّ خَرَجْتُ مَعَهُ لَيْلَةً أُخْرَى، وَالنَّاسُ يُصَلُّونَ بِصَلاَةِ قَارِئِهِمْ، قَالَ عُمَرُ نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ، وَالَّتِي يَنَامُونَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الَّتِي يَقُومُونَ. يُرِيدُ آخِرَ اللَّيْلِ، وَكَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ أَوَّلَهُ.
হযরত আবদুর রাহমান ইবনু আবদুলক্বারী রহিঃ থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেনঃ আমি রমযানের এক রাতে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিঃ- এর সাথে মাসজিদে নববীতে গিয়ে দেখি যে, লোকেরা এলোমেলোভাবে জামাআতে বিভক্ত হয়ে তারাবীর নামায আদায় করছে এবং কেউ বা একাকীভাবে নামায আদায় করছে৷ তা দেখে হযরত উমর রাযিঃ বললেনঃ আমি মনে করি এই লোকদেরকে যদি একজন ইমামের পিছনে জমা করে দেই, তবে তা উত্তম হবে। এরপর তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ কারী হযরত উবাই ইবনু কাব রাযিঃ- এর পিছনে সকলকে জমা করে দিলেন। অতপর আবার কোন এক রাতে আমি হযরত উমর রাযিঃ-এর সাথে মাসজিদে নববীতে উপস্থিত হই। তখন লোকেরা হযরত উবাই ইবনু কাব রাযিঃ এর ইমামতিতে তারাবীহ আদায় করছিল। তখন হযরত উমর রাযিঃ বললেনঃ কতই না সুন্দর ও উত্তম এই নতুন ব্যবস্থা! অতপর তিনি বললেনঃ তোমরা রাতের যে অংশে ঘুমিয়ে থাক তা রাতের ঐ অংশ অপেক্ষা উত্তম, যে অংশে তোমরা নামায আদায় কর৷ এর দ্বারা তিনি শেষ রাত বুঝিয়েছেন৷ কেননা তখন রাতের প্রথমভাগে লোকেরা তারাবীহ আদায় করত। সনদ সহীহ৷ (সহীহুল বুখারী ২০১০ হাদীস৷ মুয়াত্তা মালিক ২৪২ হাদীস৷)
হাদীস শরীফে আরও বর্নিত হয়েছে-
عَنْ يَزِيدَ بْنِ رُومَانَ أَنَّهُ قَالَ، كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فِي رَمَضَانَ بِثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةً.
ইমাম মালিক রহিঃ ইয়াযিদ ইবনু রুমান রহিঃ হতে বর্ণনা করেন- তিনি বলেছেনঃ লোকজন উমার ইবনু খাত্তাব রাযিঃ-এর খিলাফতকালে রমযানে বিশ রাক’আত তারাবীহ এবং তিন রাক’আত বিতর পড়তেন৷ সনদ সহীহ৷ মুয়াত্তা মালিক ২৪৪ হাদীস৷ সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪৩৯৪ হাদীস৷ মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার ১৪৪৩ হাদীস৷)
#হযরত_উসমান_রাযিঃ এর_তারাবীহঃ
হযরত উসমান রাযিঃ ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন৷ যেমন-
হযরত সায়েব বিন ইয়াজিদ রহিঃ বলেছেনঃ হযরত উসমান রাযিঃ এর শাসনামলে লোকেরা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। শুধু তাই নয়! ইমামের লম্বা কেরাতের কারণে লোকেরা লাঠির উপর ভর দিয়ে তারাবীহ পড়তেন৷ সনদ সহীহ৷ (সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪৬১৭ হাদীস৷ আল-খুলাসাতুল আহকাম ১৯৬১ হাদীস৷ উমদাতুল ক্কারী শরহে বুখারী ৫/২৬৪ পৃষ্ঠা৷)
#হযরত_আলী_রাযিঃ_এর_তারাবীহঃ
হযরত আলী রাযিঃ ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন! যেমন হাদীস শরীফে বর্নিত হয়েছে-
عن ابى عبد الرحمن السلمى عن على قال دعى القراء فى رمضان فامر منهم رجلا يصلى بالناس عشرين ركعة قال وكان على يوتر بهم
হযরত আবু আব্দুর রহমান সুলামী রহিঃ বলেছেনঃ হযরত আলী রাযিঃ রমজান মাসে কারীদের ডাকতেন। তারপর তাদের মাঝে একজনকে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতে হুকুম দিতেন। আর হযরত আলী রাযিঃ নিজেই বিতের পড়াতেন৷ সনদ সহীহ৷ (সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪৮০৫, ৪৩৯৭ হাদীস৷ কানযুল উম্মাল ২৩৪৭৪ হাদীস৷)
#সাহাবীদের_তারাবীহঃ
সকল সাহাবায়ে কিরাম রাযিঃ ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন৷ যেমন- তারীখুল খুলাফা তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের ইতিহাস অনুযায়ী হযরত ওমর রাযিঃ ১৫তম হিজরীতে জামাআতের সাথে ২০ রাকাত তারাবীর প্রচলন শুরু করেন। আর উম্মুল মুমিনীন হযরত সাইয়্যেদাহ আয়িশা সিদ্দীকা রাযিঃ ৫৭হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন। পুরো ৪২বছর আম্মাজান আয়শা রাযিঃ-এর হুজরার নিকটবর্তী মাসজিদে নববীতে সাহাবায়ে কিরাম রাযিঃ ২০ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন৷ দীর্ঘ এ ৪২বছরের ভিতর আম্মাজান রাযিঃ কোনদিন ২০ রাকাত তারাবীহ বা তারাবীর জামাআতের ব্যপারে কোন আপত্তি করেননি এবং কোন সাহাবীও কোনদিন কোন আপত্তি করেননি৷
অতএব সহজেই বুঝা যায় যে,২০ রাকাত তারাবীর ব্যাপারে সকল সাহাবীদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ যা শরীয়তের একটি শক্তিশালী দলিলও বটে৷ বরং শরীয়ত নিজেই ইজমাকে দলীল হিসেবে সাব্যস্ত করেছে এবং যাদের মাধ্যমে ইজমা সম্পন্ন হয় তাদের ব্যাপারে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে যে, এরা কখনো গোমরাহীর ব্যাপারে একমত পোষণ করবেনা৷ কুরআনুল কারীমে তো সুস্পষ্টভাবে মুহাজির ও আনসার সাহাবীগনের অনুসরণ করার আদেশও করা হয়েছে৷ হাদীস শরীফে হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ মনে রেখো! আমার পরে তোমরা যারা জীবিত থাকবে তারা বহু মতানৈক্য দেখতে পাবে৷ তখন তোমরা কেবল আমার সুন্নাত ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অনুসরণ করবে এবং সকল প্রকার বিদআত থেকে দুরে থাকবে৷ যেহেতু খোলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা জেনেছেন যে, তাদের জারীকৃত সুন্নাতসমুহ নবী-শিক্ষার ভিত্তিতেই হবে, তাদের সুন্নাত নবীর সুন্নাতের অনুগামী ও আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি মোতাবেকই হবে৷ তাই হযরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতকে ব্যাপকভাবে ঘোষণা দিয়ে যান যে, তোমরা খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে মজবুতভাবে আকড়ে রাখবে৷ সুতরাং যখন কোন বিষয়ে প্রমাণ হবে যে, এটি চার খলিফার কোন এক জনের সুন্নাত, তখন তার অনুসরণের জন্য হযরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর উপরোক্ত নির্দেশণাই যথেষ্ট৷ সনদ সহীহ৷ (সুনানে আবু দাউদ ৪৬০৭, ৪৬০৬ হাদীস৷ আহকামুস সিয়াম ২৬-২৭ পৃষ্ঠা৷ ফাতহুল বারী-৪/৪৩৬ পৃষ্ঠা৷ উমদাতুল কারী-৫/২৬৭ পৃষ্ঠা৷ ইরশাদুস সারী ৩/৫১৫ পৃষ্ঠা৷ ফতোয়ায়ে ইউনুসিয়া ২/৩৯০ পৃষ্ঠা৷)
#আহলে_সুন্নত_ওয়াল_জামাআতের_তারাবীহঃ
হযরত উমর রাযিঃ- এর আমল হতে দীর্ঘ ১২শত বৎসর পর্যন্ত তামাম পৃথিবীজুড়ে ২০ রাকাত তারাবীর প্রচলন ছিল৷ দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে ২০ রাকাত তারাবীর ব্যপারে কেহ কোন প্রকার দ্বিমত পোষণ করেনি৷ সুতরাং প্রমানিত হলো যে, দীর্ঘ ১২শত বছর পর্যন্ত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকলেই ২০ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন৷ বিশ্ব বিখ্যাত মুহাদ্দীস হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলবী রহঃ বলেছেনঃ বর্তমান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত চার মাযহাবে সীমাবদ্ধ। চার মাযহাবের বাহিরে কেউ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত নয়! আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত পরিচিতিঃ
১৷ হানাফী মাযহাব৷
২৷ মালেকী মাযহাব৷
৩৷ শাফেয়ী মাযহাব৷
৪৷ হাম্বলী মাযহাব৷
(ফতোয়ায়ে কাজীখান ১/১১২ পৃষ্ঠা৷ ফতোয়ায়ে শামী ১/৫১১ পৃষ্ঠা৷ মিরকাত- শরহে মিশকাত ৩/১৯৪ পৃষ্ঠা৷ ইতহাফুল সাদাতুল মুত্তাকীন ৩/৪২২ পৃষ্ঠা৷ আহকামুস সিয়াম ২৬ পৃষ্ঠা৷)
#চার_মাযহাবের_তারাবীহঃ
১৷ #হানাফী_মাযহাবঃ
হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানীফা রহিঃ এর মতে তারাবীহ নামায ২০ রাকাত৷ (ফতোয়ায়ে কাজীখান ১/১১২ পৃষ্ঠা৷ ইলাউস সুনান ৭/৬৯-৭১ পৃষ্ঠা৷ শরহুস সুন্নাহ ২/৫১১ পৃষ্ঠা৷ আল মুগনী ২/৬০৪ পৃষ্ঠা৷)
২৷ #মালেকী_মাযহাবঃ
মালেকী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মালিক রহিঃ- এর মতে তারাবীহ নামায ২০ রাকাত৷ (ইলাউস সুনান ৭/৬৯-৭১ পৃষ্ঠা৷ শরহুস সুন্নাহ ২/৫১১ পৃষ্ঠা৷ আল মুগনী ২/৬০৪ পৃষ্ঠা৷ হেদায়াতুল মুজতাহিদ ১/১৬৭ পৃষ্ঠা৷)
৩৷ #শাফেয়ী_মাযহাবঃ
শাফেয়ী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম শাফেয়ী রহিঃ- এর মতে তারাবীহ নামায ২০ রাকাত৷ (ইলাউস সুনান ৭/৬৯-৭১ পৃষ্ঠা৷ শরহুস সুন্নাহ ২/৫১১ পৃষ্ঠা৷ আল মুগনী ২/৬০৪ পৃষ্ঠা৷)
৪৷ #হাম্বলী_মাযহাবঃ
হাম্বলী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহিঃ- এর মতে তারাবীহ নামায ২০ রাকাত৷ (ইলাউস সুনান ৭/৬৯-৭১ পৃষ্ঠা৷ শরহুস সুন্নাহ ২/৫১১ পৃষ্ঠা৷ আল মুগনী ২/৬০৪ পৃষ্ঠা৷)
#_৮_রাকাত_তারাবীহ_নামে_সর্বপ্রথম_বিদআতের_সূচনাঃ
প্রচলিত আহলে হাদীস নামক বাতিল ফিরকার আবিস্কার মতে তারাবীহ নামায ৮ রাকাত৷ সর্বপ্রথম ১২৮৪ হিজরীতে ভারতের আকবরাবাদ থেকে এক লা-মাযহাবী মৌলভী সাহেব ৮ রাকাত তারাবীর ফতোয়া প্রদান করেন। এরপর ১২৮৫ হিজরীতে পাঞ্জাব সীমান্তে প্রসিদ্ধ গায়রে মুকাল্লিদ ভন্ড ও প্রতারক শায়েখ মুহাম্মাদ হুসাইন বিটালভী ফতোয়া দিল যে, ৮ রাকাত তারাবীহ পড়া সুন্নত৷ আর ২০ রাকাত তারাবীহ পড়া বিদআত৷ সে সুন্নতকে বিদআত আর বিদআতকে সুন্নাত বলে ফতোয়া দিল৷ কিন্তু তৎকালীন প্রাজ্ঞ হক্কানী উলামায়ে কেরামগণ তার এ ফতোয়াকে ভুল হিসেবে প্রমাণিত করেন এবং ৮ রাকাত তারাবীহ নামক বিদআতকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ২০ রাকাত তারাবীর সুন্নত আমলকে অব্যহত রাখেন।
অতপর ১৩৭৭ হিজরীতে আরবে প্রসিদ্ধ দুই লামাযহাবী ও প্রতারক শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী ও শায়েখ নসীব রেফায়ী ৮ রাকাত তারাবীর মত প্রকাশ করেন। তখন শায়েখ আতিয়্যা সালিমসহ আরবের জমহুর উলামায়ে কেরামগণ তাদের উক্ত রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন এবং সাহাবায়ে কেরাম রাযিঃ এর যুগ থেকে চলে আসা ২০ রাকাত তারাবীর আমলকে অব্যহত রাখেন। যা আজো অব্যাহত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে- ইনশাআল্লাহ!! (আহকামুস সিয়াম ২৭-২৮ পৃষ্ঠা৷ রাসায়েলে আহলে হাদীস ২/২৮ পৃষ্ঠা৷ ফতোয়ায়ে জামেয়া ১/১৪৬ পৃষ্ঠা৷)
#আহলে_হাদীস_নামক_বাতীল_ফিরকাদের_৮_রাকাত_তারাবীর_ব্যর্থ_দলীলঃ
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي رَمَضَانَ فَقَالَتْ مَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ، وَلاَ فِي غَيْرِهَا عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً،
হযরত আবূ সালামা ইবনু আবদুর রাহমান রহঃ থেকে বর্ণিত৷ তিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা সিদ্দীকা রাযিঃ-কে জিজ্ঞেস করেন-রমযানে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর সালাত কিরূপ ছিল? উত্তরে আম্মাজান রাযিঃ বললেনঃ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযান ও রমযান ব্যতীত অন্য সময়ে রাতে ১১ রাকাত নামায আদায় করতেন৷ সনদ সহীহ৷ (সহীহুল বুখারী ২০১৩ হাদীস৷)
সকল মুহাদ্দিসিনে কিরামের মতে উক্ত হাদীসের ১১রাকাত নামাযের মধ্যে ৮রাকাত হলো তাহাজ্জুদ৷ আর বাকি ৩-রাকাত হলো বিতর৷ কিন্তু হাস্যকর ব্যপার হলো আহলে হাদীসের শায়েখরা তাহাজ্জুদ এবং তারাবীর তফাতও বুঝেনা৷ তারা এটাও জানেনা যে, তারাবীহ কোন মাসে পড়তে হয়! কেননা উক্ত হাদীস যদি তারাবীহ সংক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে তো ১২মাস তারাবীহ পড়ার কথা৷ কারন উক্ত হাদীসে পরিস্কার বর্নিত হয়েছে নবীজী রমযান ও অন্যান্য মাসে ৮ রাকাত নামায পড়তেন৷ আর আমরা সকলেই যানি যে, তারাবীহ ১২ মাস পড়া হয়না, বরং ১২ মাস পড়া হয় তাহাজ্জুদ নামায৷ কাজেই প্রমানিত হল যে, এটি তারাবীহ সংক্রান্ত হাদীস নয়! বরং তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত হাদীস৷
অতএব ৮ রাকাত তারাবীহ পড়ার মতকে গ্রহণ করার অর্থ হল- সাহাবী ও তাবেয়ীগণের অনুসৃত আমলকে প্রত্যাখ্যান করে নব্যসৃষ্ট বিদআতী দলের অনুসরণ করা। অথচ এরুপ নব-আবিষ্কৃত বিদআত সম্পর্কে হযরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায় ১৫শত বছর পুর্বেই উম্মতকে সতর্ক করে বলেছেন যে- তোমরা নব-আবিষ্কৃত বিদআত থেকে খুব সতর্কতার সঙ্গে বেচে থাকবে৷ কেননা, প্রতিটি নব আবিষ্কৃতই বিদআত৷ আর প্রতিটি বিদআত হলো গোমরাহী৷ আর প্রতিটি গোমরাহী জাহান্নামে যাবে৷ সনদ সহীহ৷ (সুনানে আবু দাউদ ৪৬০৭, ৪৬০৬ হাদীস৷ আহকামুস সিয়াম ২৬-২৮ পৃষ্ঠা৷)
পরিশেষে একটি হাদীসের মাধ্যমে লেখা ইতি টানছি-
وَعَنْ اَبِىْ قَتَادَة قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ أَسْوَأُ النَّاسِ سَرِقَةً الَّذِي يَسْرِقُ مِنْ صَلَاتِه قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ يَسْرِقُ مِنْ صَلَاتِه قَالَ لَا يُتِمُّ رُكُوعَهَا وَلَا سُجُودَهَا. رَوَاهُ أَحْمَد
হযরত আবূ ক্বাতাদাহ্ রাযিঃ থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ চুরি হিসেবে সবচেয়ে বড় চোর হল ঐ ব্যক্তি যে নামাযে চুরি করল। সহাবীগণ আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল! নামাযে কিভাবে চুরি করে? নাবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ নামাযের চুরি হল রুকূ’-সাজদাহ্ পূর্ণ না করা। সনদ সহীহ৷ (মিশকাতুল মাসাবীহ ৮৮৫ হাদীস৷ মুসনাদে আহমাদ ২২১৩৬ হাদীস৷ সহীহ আত্ তারগীব ৫২৪ হাদীস৷)
উক্ত হাদীসের আলোকে আমি (মুফতী তাহমীদ শামী) বলতে চাই যে, নামাযে রুকু সিজদা সঠিকভাবে আদায় না কারী যদি বড় চুর হয়! তবে নামাযে রাকাত চুরি করলে কি হবে? যেমন যারা ২০ রাকাত তারাবীর মধ্যে ১২ রাকাতই চুরি করে তারা কি!? চুর!? না ডাকাত!??
আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে এ সমস্ত নামায চুর ও ডাকাত শায়েখদের থেকে হেফাজত করুন!!
والله اعلم بالصواب
مفتى تحميد شامى
#উত্তর_লিখনেঃ
#মুফতী_তাহমীদ_শামী
আত তাহমীদ ইসলামীক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ৷
তারিখ-২৭ শাবান ১৪৪৩ হিজরী৷
৩১/৩/২০২২ ঈসায়ী৷